বাংলার হারানো গৌরব ফিরে পেতে গেলে

বাংলার হারানো গৌরব ফিরে পেতে গেলে সবার আগে প্রয়োজন জাতিসত্তা গঠনের অসম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার পুনর্জাগরণ। বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, লুপ্তপ্রায় হস্তশিল্প ও সর্বোপরি স্বাধীনতা আন্দোলনের গৌরবময় অধ্যায়কে এই প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা দরকার সবার আগে। যেমন-

ক) কলকাতার উপকন্ঠে কিছু বিশ্বমানের স্মৃতি সৌধ নির্মান করে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে শুরু হোক জাতিসত্তা গঠনের প্রথম পদক্ষেপ। ওই স্মৃতি সৌধের মধ্যে দুটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে শহিদদের উদ্দেশেও নির্মিত হোক দুটি স্বতন্ত্র স্তম্ভ।

খ) শুধু স্মৃতিসৌধ নির্মানই যথেষ্ট নয়। স্মৃতিসৌধের পাশেই নির্মান হোক এক আধুনিক সংগ্রহশালা যেখানে প্রত্যেক স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম, ছবি ও তাঁদের আত্মত্যাগের কথা লিপিবদ্ধ থাকবে সাধারণ দর্শক ও ছাত্রছাত্রীদের জন্যে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার গৌরবময় ভূমিকা সবার জানা উচিত। সবাইকে জানানো উচিত।

গ) পূর্ববঙ্গ স্বাধীনতার লড়াই করেছে দু’বার। একবার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়বার পাকিস্তানী শাসকের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় স্বাধীনতার লড়াই ছিল তার জাতিসত্তার লড়াই। সে দেশের নতুন স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ। বাংলাদেশের জনগণ আরও একটি দিন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে- ২১ ফেব্রুয়ারি যা এখন আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস বলে সারা বিশ্বে সম্মানিত।

ভারতের স্বাধীনতা দিবস(১৫ অগস্ট) আসলে বাঙালি ও পাঞ্জাবি জাতি গোষ্ঠীর কাছে এক অভিশপ্ত স্মরণ দিবস। স্বজন হারানোর দিন। ভাগ হওয়ার দিন। অঙ্গচ্ছেদের দিন।

এ রাজ্যে ভাষা শহিদ নেই। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা হয়েছিল এই রাজ্যেই। ১৯৪২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বিপ্লবী সতীশ সামন্তের নেতৃত্বে ‘তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’(Tamralipta National Government) গঠিত হয়েছিল ইতিহাস প্রসিদ্ধ তাম্রলিপ্ত(অধুনা তমলুক) বন্দরের পাশেই। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার ১৯৪৪-এর সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মুক্ত ছিল।

আমার প্রস্তাব ১৭ ডিসেম্বর রাজ্যে ‘মুক্তি দিবস’ হিসেবে পালিত হোক। প্রস্তাবিত স্মৃতিসৌধ নির্মিত হোক তমলুক ও কলকাতার মাঝামাঝি কোনো এক স্থানে। রাজ্য সরকার ঘোষিত যাবতীয় পুরস্কার প্রদান হোক ওই ১৭ ডিসেম্বর ‘মুক্তি’ দিবসে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১ মে দিনটি মারাঠিরা ‘মহারাষ্ট্র দিবস’ হিসেবে মহাসমারোহে পালন করে। ওই একই দিনে গুজরাটিরা পালন করে ‘গুজরাট স্থাপনা দিবস’। ১ নভেম্বর তামিলনাড়ুতে ‘তামিলনাড়ু প্রতিষ্ঠা দিবস’ পালিত হয় আর ২ জুন পালিত হয় তেলেঙ্গানা দিবস হিসেবে।

যে জাতি তার ভাষা, জনতত্ত্বগত বৈশিষ্ট্য ও নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সম্মান জানাতে কুন্ঠিত হয়, সে জাতির ভবিষ্যৎ কখনই গৌরবের হয় না। হতে পারে না। সে না পারে নিজেকে সম্মান করতে না পারে অন্যের সম্মান রাখতে। পশ্চিমবঙ্গের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার পূর্ব শর্তই হচ্ছে অতীতকে ফিরে দেখা- নিজেদের হৃত সম্মান ফিরে পাওয়া।

বাস্তবে ভারত নামক ‘দেশ’টি বহুজাতির বাসভূমি। সে অর্থে একটি ‘যুক্তরাষ্ট্র’(Federation of States)। সংবিধান বর্ণিত ‘রাষ্ট্রসংঘ’(Union of States) নয়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই সহজ সত্যটি অনুধাবন না করলে এ রাজ্যের হারানো গৌরব ফেরানো অসম্ভব।

One thought on “বাংলার হারানো গৌরব ফিরে পেতে গেলে

Leave a comment